আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় কেন?
*****************************************
⏩ ঘূর্ণিঝড় একটি আবহিক ঘটনা। সহজ ভাবে বললে, ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বায়ুমন্ডলে সুবিশাল এলাকা জুড়ে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে, যে প্রবল গতিসম্পন্ন ঝড় দেখা যায়, তাকে ঘূর্ণিঝড় বলে। ভারত মহাসাগরীয় ঘূর্ণিঝড় 'সাইক্লোন' (Cyclone) নামে পরিচিত। 'Cyclone' শব্দটি গ্রিক শব্দ 'Kyklos/Kukloma' থেকে এসেছে, যার অর্থ হল সাপের কুন্ডলী। ১৮৪৮ সালে হেনরি পিডিংটন সাইক্লোন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাৎপর্য্যপূর্ণ ভাবে দেখা যায়, আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে অনেক বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। ১৯৮৩-২০১৫ সময়কালে উত্তর ভারত মহাসাগরে ১৭২ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ১১৬ টি এবং আরব সাগরে ৫৬ টি। অর্থাৎ ১৯৮৩-২০১৫ সময়কালে উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের ৬৭.৪৪%-ই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু কেন? 👇
অধিকাংশ আবহিক ঘটনার পিছনে শুধুমাত্র একটি কারণ কাজ করে না। অনেকগুলি কারণ মিলিতভাবে কাজ করে। বঙ্গোপসাগরে অধিক সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পিছনেও অনেকগুলি বিষয় সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে, প্রথমে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের অবস্থান একটু জেনে নেওয়া যাক। বঙ্গোপসাগর অবস্থান করছে উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরে ; যার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাগত অবস্থান ৫° উত্তর থেকে ২৪° ডিগ্রি উত্তর এবং ৭৮° পূর্ব থেকে ৯৫° পূর্ব (IHO)। অন্যদিকে, আরব সাগর উত্তর-পশ্চিম ভারত মহাসাগরের অবস্থান করছে ; যার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাগত অবস্থান ০° থেকে ২৫° উত্তর এবং ৫১° পূর্ব থেকে ৭৪° পূর্ব।(IHO)।
👉 কেন আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তরে এবার আসা যাক। বঙ্গোপসাগরের আয়তন ২৬,০০,০০০ বর্গকিমি এবং আরব সাগরের আয়তন ৩৮,৬২,০০০ বর্গকিমি। অতএব আরবসাগরের আয়তন ১২,৬২,০০০ বর্গকিমি বেশি। জলভাগের আয়তন যেহেতু বঙ্গোপসাগরের তুলনায় আরব সাগরের অনেক বেশি, তাই আরব সাগরের জলের মধ্যে সমান্তরাল সঞ্চালন বেশি কাজ করে। আর তাই আরব সাগরের তাপমাত্রা বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রার চেয়ে কম। আরব সাগরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বাধিক তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গড় তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বাধিক তাপমাত্রা ৩১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গড় তাপমাত্রা ৩০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।অতএব ঘূর্ণিঝড়ের জন্য যে সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দরকার, সেটা সবসময়ই বঙ্গোপসাগরে থাকে।
_____________________________________________
★বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য ঘূর্ণিঝড় (২০০৭-২১)★
সিডার -- ২০০৭ : আয়লা -- ২০০৯
লায়লা -- ২০১০ : নীলম -- ২০১২
হুদহুদ -- ২০১৪ : তিতলি -- ২০১৮
ফনি -- ২০১৯ : বুলবুল -- ২০১৯
আম্ফান -- ২০২০ : ইয়াস -- ২০২১
★আরব সাগরে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য ঘূর্ণিঝড় (২০০৭-২১)★
গোনু -- ২০০৭ : ফেট -- ২০১০
নিলোফার -- ২০১৪ : চপলা -- ২০১৫
অক্ষি -- ২০১৭ : গজা -- ২০১৮
মেকুনু -- ২০১৮ : হিক্কা -- ২০১৯
কিয়ার -- ২০১৯ : তাউকতাই -- ২০২১
_____________________________________________
⏩ সোমালিয়া স্রোত এবিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সোমালিয়া স্রোতের জন্য আরব সাগরের পৃষ্ঠদেশীয় তাপমাত্রা (Surface Temperature) হ্রাস পায় এবং বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন কিভাবে?? সোমালিয়া স্রোত আরব সাগরের পৃষ্ঠদেশীয় উষ্ণ জলকে প্রবাহিত করে বঙ্গোপসাগরের দিকে নিয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটায়। এজন্য বঙ্গোপসাগরে বেশি পরিমাণ ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে কিছুটা হলেও সাহায্য করে। এছাড়া আরব সাগরের মধ্যে দ্বীপের সংখ্যাটা বঙ্গোপসাগরের তুলনায় অনেক কম। বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৫৭২ টি দ্বীপ রয়েছে। জলভাগ এবং স্থলভাগের জলভাগের এইরূপ বৈষম্য বঙ্গোপসাগরে যেহেতু বেশি, তাই বঙ্গোপসাগরে অধিক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে এটিও অনেকটা কার্যকারী ভূমিকা গ্রহণ করে।
জলভাগের গড় গভীরতাও এই বিষয়ে বিশেষ প্রভাব ফেলে। আরব সাগরের গভীরতা ২৭৩৪ মিটার বা ৮৯৭০ ফুট, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের গড় গভীরতা ২৬০০ মিটার বা ৮৫০০ ফুট। যেহেতু আরব সাগরের গড় গভীরতা বেশি, তাই আরব সাগরের মধ্যে জলের উল্লম্ব সঞ্চালন বেশি দেখা যায়। উল্লম্ব সঞ্চালনের জন্য নিচের শীতল জল বেশি পরিমানে উপরে উঠে আসে। এজন্য আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে কিছুটা হলেও বাধার সৃষ্টি করে। এছাড়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর জন্যও আরব সাগরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়, যা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে আরব সাগরে প্রতিবন্ধক রূপে কাজ করে।
আবার, আমরা যদি ভারতের ৭৫১৬ কিমি দীর্ঘ উপকূলরেখার সাইক্লোন করিডোর (Cyclone Corridor)-টি দেখি, তাহলে সেটাও ভারতের পূর্ব উপকূল বরাবর বেশি চওড়া। অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে যে বেশি সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে, তার ইঙ্গিত বহন করে। আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে স্বাদু জলের জোগান অনেক বেশি। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি অসংখ্য ছোটোবড়ো নদনদী বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। যা বঙ্গোপসাগরের জলের মধ্যে লবনতা অনেকটা কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা জানি যে, লবণাক্ত জলের থেকে লবণ মুক্ত জল বেশি তাড়াতাড়ি গরম হয়। এটি বঙ্গোপসাগরে বেশি সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে, সিন্ধু নদ ছাড়া আর কোনো বড়ো নদনদী আরব সাগরে পতিত হয়নি। ফলে স্বাদুজলের জোগান কম হওয়াতে আরব সাগরে লবণতা বেশি। যা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পক্ষে অনুকূল নয়।
****************************************