Movements of the earth (পৃথিবীর গতি সমূহ)
প্রাচীনকালে গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লডিয়াস টলেমি (Claudious Ptolemy) পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের কথা প্রচার করতেন। তাঁর মতে, পৃথিবী স্থির রয়েছে, আর সূর্যসহ যাবতীয় জ্যোতিষ্ক পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চলেছে। প্রাতে পূর্বাকাশে সূর্যোদয় এবং দিবাশেষে পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্ত দেখে আদিম মানুষ টলেমির মতবাদকে মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন, আসলে সূর্যই স্থির রয়েছে, আর পৃথিবী আবর্তনরত অবস্থায় সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।
অর্থাৎ, পৃথিবীর দুটি গতি, যথা—–(1) আবর্তন এবং (২) পরিক্রমণ— উভয়ই একসঙ্গে কার্যকরী রয়েছে।
আমাদের ভুল হওয়ার কারণ আমরা গতিশীল পৃথিবীর বুকে বাস করছি। যেমন— চলন্ত গাড়িতে ভ্রমণ করলে মনে হয়, গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে, আর দু-পাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা, দোকানপাট ইত্যাদি সবকিছুই পেছনের দিকে ছুটে চলেছে। এরকম ভুল পৃথিবী ও সূর্যের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে।
⏩ পৃথিবীর আবর্তন বা আহ্নিক গতি (Rotation of the Earth)
আবর্তন গতির সংজ্ঞা (Definition of Rotation) :
যে গতিতে পৃথিবী নিজের মেরুরেখার (Axis) ওপর দাঁড়িয়ে আপন দেহকে পশ্চিমদিক থেকে পূর্বদিকে অনবরত পাক খাওয়াচ্ছে বা ঘোরাচ্ছে, পৃথিবীর সেই গতিকে বলা হয় আবর্তন গতি (Rotation)।
এই গতিতে নিজের দেহকে একবার সম্পূর্ণরূপে ঘোরাতে বা পাক খাওয়াতে পৃথিবীর সময় লাগে ২৪ ঘণ্টা (অবশ্য সূক্ষ্ম হিসেবে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড)। এই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা দিবা এবং ১২ ঘণ্টা রাত্রি নিয়ে একটি সম্পূর্ণ দিন সংঘটিত হয়। সূর্যকিরণের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় বলে এর নাম হয়েছে সৌরদিন (Solar Day)।
আবার এই গতিতে পৃথিবী দিনে একবার নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আবর্তন করে বলে এই গতির অপর নাম আহ্নিক গতি (Diurnal Motion ) আহ্নিক' কথাটি 'অহ্ন' থেকে এসেছে, যার অর্থ দিন।
🔸পৃথিবীর অপসূর ও অনুসূর অবস্থান (Aphelion and Perihelion Dis tance of the Earth) :
↔️যদিও সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার, কিন্তু সূর্য প্রদক্ষিণ করার সময় এই দূরত্ব সারা বছর একই থাকে না। ৪ ই জুলাই এই দূরত্ব থাকে সর্বাধিক প্রায় ১৫ কোটি ২০ লক্ষ কি.মি.। একে পৃথিবীর অপসূর অবস্থান (Aphelion Distance) বলে।
আর ৩ ই জানুয়ারি পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে। তখন এই দূরত্ব হয় ১৪ কোটি ৭০ লক্ষ কি.মি.। একে পৃথিবীর অনুসূর অবস্থান (Perihelion Distance) বলে।
⏩ আবর্তন গতির ফলসমূহ (Effects of Rotation)
🔸দিবারাত্রির উদ্ভব (Formation of Day and Night)
আবর্তন গতির ফলে পৃথিবীতে পালা করে দিবারাত্রি সংঘটিত হয়। আবর্তনের ফলে পৃথিবীর যে-দিক সূর্যের সামনে আসে সূর্যের কিরণ পড়ার ফলে সেখানে হয় দিবা (Day) | আর ঠিক তার উলটো দিকে, সূর্যের আলো পৌছায় না বলে, সেখানে হয় রাত্রি (Night)। পৃথিবীর ক্রমআবর্তনের ফলে আলোকিত দিকটা অন্ধকারে এবং অন্ধকার দিকটা সূর্যের সামনে আসে। তখন দিবা ও রাত্রি পালটে যায়।
🔸ছায়াবৃত্ত (Shadow Circle)
আবর্তনের ফলে গোলাকার পৃথিবীর একটি স্থানে আলো ও অন্ধকার এক বৃত্তাকার সীমারেখায় পরস্পর মিলিত হয়। একে বলে ছায়াবৃত্ত। এর আলোকিত দিকটা হয় দিবা আর অন্ধকার দিকটা হয় রাত্রি।
🔸দিবারাত্রির বিভিন্ন অবস্থা (Various stages of Day and Night):
আবর্তনের ফলে পৃথিবীর যে অংশ ছায়াবৃত্ত পার হয়ে অন্ধকার থেকে আলোকিত দিকে প্রবেশ করে সেখানে হয় প্রভাত (Morning)। আর তার বিপরীত দিকটি আলোকিত অংশ থেকে অন্ধকারে প্রবেশ করে বলে তখন সেখানে হয় সন্ধ্যা (Evening)। আবার যখন যেখানে হয় দুপুর (Noon), ঠিক তার বিপরীত দিকে তখন হয় মধ্যরাত্রি (Midnight)। দিবারাত্রির বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে আলো ও উন্মতার পার্থক্য ঘটে।
🔸নিয়ত বায়ুপ্রবাহের গতিবিক্ষেপ (Deflection of Planetary Wind)
পৃথিবীর আকৃতি গোলাকার। এর মধ্যভাগ থেকে উভয় মেরুর দিকে আয়তন ও পরিধি ক্রমশ কম। ফলে মধ্যভাগের চেয়ে দুটি মেরুর কাছে আবর্তনের গতিবেগও ক্রমশ কমে যায়। তাই কোনো বায়ুপ্রবাহ যখন মেরু অঞ্চল থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে বয়ে আসে, তখন তার (ওই বায়ুপ্রবাহের) আবর্তনের গতিবেগও নিরক্ষীয় অঞ্চলের আবর্তনের গতিবেগের চেয়ে কম থাকে। অথচ ওই বায়ুপ্রবাহ আগেকার গতিবেগ বজায় রাখার চেষ্টা করে। তাই ওইসব বায়ু অর্থাৎ পৃথিবীর নিয়ত বায়ুগুলো সোজা পথে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে না গিয়ে কিছুটা বেঁকে প্রবাহিত হয়। একেই বলা হয় নিয়ত বায়ুপ্রবাহের গতিবিক্ষেপ (Deflection of Planetary Winds) |
⏩ ফেরেল-এর সূত্র (Ferrel's Law) :
প্রকৃতপক্ষে 'ফেরেল সূত্র হল নিয়ত বায়ুপ্রবাহের গতিবিক্ষেপের নামান্তর মাত্র। পৃথিবীর আবর্তনজনিত বলের (Coriolis force) প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের নিয়ত বায়ুগুলো, যথা- (১) আয়ন বায়ু, (২) পশ্চিমা বায়ু ও (৩) মেরু বায়ু–উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার দিকে (Clockwise) বেঁকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাঁদিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে (Anti-clockwise) • বেঁকে প্রবাহিত হয়। বিষয়টি বৈজ্ঞানিক ফেরেল সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন বলে বায়ুপ্রবাহের এই নিয়ম 'ফেরেল-এর সূত্র (Ferrel's Law)' নামে পরিচিত।
এছাড়া আহ্নিক গতির ফলে (৩) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়, (৪) সমুদ্রস্রোতের দিক পরিবর্তন ঘটে, (৫) উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উদ্ভব হয়েছে, (৬) সময় গণনার সুবিধে হয়। ইত্যাদি।
0 Comments