⚫ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা (Definition of Political Science)
🔸সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞার অভাব
মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গেে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধ্যানধারণারও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই অদ্যাবধি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্দেশ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এস্. এল. ওয়াসবি (S. L. Wasby) বলেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও মতপার্থক্য এবং এর পরিবর্তনশীল প্রকৃতি ও অনিশ্চিত আলোচনাক্ষেত্রের সীমানা কোনো একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞাকে যথার্থ হতে দেয় না। স্বাভাবিক কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদানের প্রয়াস পেয়েছেন। এই সংজ্ঞাগুলিকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা-
(১) রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা
(২) অ-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা।
🔸 রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা :
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞাকে সাধারণভাবে সনাতন বা সাবেকি সংজ্ঞা বলা হয়। সনাতন ধারণা অনুসারে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, কার্যাবলি প্রভৃতি যে শাস্ত্রে আলোচিত হয়, তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়। প্রখ্যাত রাষ্ট্রদার্শনিক বুন্টস্লি (Bluntschli)-র মতে, যে-শাস্ত্র রাষ্ট্রের ভিত্তি, মৌলিক অবস্থা ও প্রকৃতি এবং এর বিভিন্ন রূপ ও বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে, তাকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলা হয়। অধ্যাপক গার্নার (Garner) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে সেই শাস্ত্রটির কথা উল্লেখ করেছেন, যা কেবল রাষ্ট্রকে নিয়ে আলোচনা করে। অধ্যাপক গেটেল (Gettel) বলেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলরাষ্ট্র কী ছিল তার ঐতিহাসিক অনুসন্ধান, বর্তমান রাষ্ট্র সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক ও নীতিশাস্ত্রসম্মত আলোচনা। এমনকি, র্যাফেল (Raphael) প্রমুখ অনেক আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একথা মনে করেন যে, যা রাষ্ট্রকে স্পর্শ করে তা-ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
বিষয়বস্তুর অন্তর্গত—এই পূর্বতন মতবাদ এখনও গ্রহণযোগ্য। আবার, পল জানে (Paul Janet)-র মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই অংশ, যা রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি এবং সরকারের নীতিসমূহ নিয়ে আলোচনা করে। সিলি (Seely), লিকক (Leacock), ক্যাটলিন (Catlin) প্রমুখও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বার্জেস (Burgess)-এর মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার বিজ্ঞান।
🔸 রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অ-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা:
কিন্তু গ্রাহাম ওয়ালাস (Graham Wallas), আর্থার বেন্টলে (Arthur Bentley), লাসওয়েল (Lasswell), অ্যালান বল, ডেভিড ইস্টন প্রমুখ আধুনিক আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পূর্বোক্ত সংজ্ঞাগুলিকে সংকীর্ণতাদোষে দুষ্ট বলে অভিযোগ করেন। তাঁদের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবল রাষ্ট্রকে নিয়ে আলোচনা করে না, সেই সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির রাজনৈতিক আচার আচরণ, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভৃতি নিয়েও আলোচনা করে। লাসওয়েলের মতে, সমাজের প্রভাব ও প্রভাবশালীদের সম্পর্কে আলোচনা ও বিশ্লেষণের নামই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রবার্ট ডাল (Robert Dahl)-কে অনুসরণ করে বলা যায়, যখন সমাজস্থ কোনো ব্যক্তি নিজ ইচ্ছানুসারে অন্য কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নেয়, তখন পূর্বোক্ত ব্যক্তিকে ‘প্রভাবশালী' এবং তার ক্ষমতাকে ‘প্রভাব' বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন ব্যক্তির প্রভাবের মধ্যে তুলনামুলক আলোচনা ছাড়া রাজনৈতিক জীবনের পর্যালোচনা করা সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। তিনি ক্ষমতা, শাসন বা কর্তৃত্ব (power. rule or authority)-কে রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান প্রতিপাদ্য বলে বর্ণনা করেছেন। ১১ অ্যালান বলের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সেই বিষয়, যা সমাজদ্ধ মানুষের বিরোধ এবং বিরোধের মীমাংসা নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু ডেভিড ইস্টন রাষ্ট্র কিংবা ক্ষমতা কোনোটিকেই রাজনৈতিক অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু বলে মনে করেন। না। তাঁর মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল মূল্যের কর্তৃত্বমূলক বণ্টনের পাঠ' (the study of the author itative allocation of values)। কারণ, তা ক্ষমতার বণ্টন ও প্রয়োগের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। কোনো মূল্যবান বস্তুর বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ বাধলে প্রচলিত প্রথার ভিত্তিতে যখন সেইসব বিরোধের মীমাংসা করা সম্ভব হয় না, তখন সামাজিক কর্তৃত্বের সাহায্যে একটি নীতি প্রণয়ন করা হয়। এই নীতি বা সিদ্ধান্তকে ‘কর্তৃত্বসম্পন্ন' বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। প্রয়োজন হলে সামাজিক কর্তৃত্ব বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজের সিদ্ধান্তকে কার্যকর করে। সুতরাং, ব্যাপক অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল এমন একটি বিষয়, যা ক্ষমতা, শাসন বা কর্তৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের স্থায়ী একটিসম্পর্ক নির্ধারণকারী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু এরূপ ব্যাপক অর্থে প্রদত্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা গ্রহণ করতে অনেকেই সম্মত নন।
🔸গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা
পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, বিশ ও একুশ শতকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর পরিধি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এই নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি রেখে আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মোটামুটি সন্তোষজনক একটি সংজ্ঞা নির্দেশ করতে পারি
রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই শাখা, যা বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের তত্ত্ব, সংগঠন, শাসনপ্রণালী ও তার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক আইন, সংগঠন ইত্যাদি সম্পর্কে এবং বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা ও মূল্যায়ন করে।