সামন্তপ্রথার অবক্ষয়ের কারণগুলি আলোচনা করো।
ভূমিকা : ইউরোপের ইতিহাসের মধ্যযুগের প্রধান ভিত্তি হল সামন্তপ্রথা। খ্রিস্টীয় দশম একাদশ শতাব্দী হতে ইউরোপে সামন্তপ্রথার চরম বিকাশ ঘটেছিল, যদিও সামন্তপ্রথা খ্রিস্টীয় সপ্তম হতে অষ্টম শতকের মধ্যে শুরু হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রথা ইউরোপের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে সামন্তপ্রথার অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছিল।
প্রথমত, সামন্ততন্ত্রের মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। জমির মালিকানা ছিল সামন্তপ্রভুদের হাতে। আর চাষাবাদ করত ‘সার্ফ' বা ভূমিদাসরা। তারা বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য থাকত। কিন্তু নতুন নতুন নগরের প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটল। এই পরিস্থিতিতে ভূমিদাসরা তাদের সামন্তপ্রভুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বিভিন্ন কলকারখানাতে কাজে নিযুক্ত হল।
দ্বিতীয়ত, দ্বাদশ শতকে সংঘটিত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে বহু সামন্তপ্রভু যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধে সামন্তদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়; বহু সামস্ত নিহত হন। যারা জীবিত থাকলেন তাঁরাও ভগ্ন হৃদয়ে দেশে ফিরলেন। এভাবে আর্থিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই সামন্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।
তৃতীয়ত, ধর্মযুদ্ধের পরোক্ষ ফলে নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে। এই ধর্মযুদ্ধের ফলে ইউরোপবাসীদের মনে এক পরিবর্তন এল। আরবীয়দের সংস্পর্শে এসে আরবীয়দের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চা ইউরোপে প্রসার লাভ করল। এর ফলে সামন্তপ্রথার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের সৃষ্টি হল।
চতুর্থত, বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশের ফলে এক শক্তিশালী বণিক ও শিল্পপতি শ্রেণির উদ্ভব হয় এভাবে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণিরও সৃষ্টি হয়। এদের জীবনদর্শন সামন্তপ্রভুদের থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা যুক্তিবাদী ও কুসংস্কার মুক্ত হওয়ায় তাদের সঙ্গে সামন্তপ্রভুদের বিরোধ বাধে।
পঞ্চমত, চতুর্দশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বুকে নেমে আসে 'ব্ল্যাক ডেথ' নামে এক ভয়ংকর মহামারির করাল ছায়া। এর ফলে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চাষি বা ভূমিদাসের মৃত্যু হয়।
ষষ্ঠত, চতুর্দশ শতাব্দীতে বিভিন্ন কারণে বহু স্থানে কৃষকরা বিদ্রোহ করে। তাদের অনেকে শহরে এসে শ্রমিক বা শিল্পীদের দলে যোগ দেয়। অনেকে স্বাধীন ছোটোখাটো ব্যাবসা শুরু করে। অনেকে পালিয়ে গিয়ে স্বাধীন প্রজায় পরিণত হয়। এভাবে সামন্তপ্রথার ভিত্তিতেই ভাঙনের সূচনা হয়।
সপ্তমত, বারুদের আবিষ্কার হলে যুদ্ধ নীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বারুদ তৈরির ক্ষমতা ছিল কেবলমাত্র রাজার। ফলে তারা প্রচণ্ড শক্তিশালী হতে শুরু করে।
অষ্টমত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও সেই সঙ্গে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। এর ফলে সামন্তদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি নষ্ট হতে থাকে।
নবমত, নতুন নতুন শহর ও বন্দরের উদ্ভব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার হতে শুরু করল। এভাবে নগরকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠল। এর ফলে সামস্ততন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে।
দশমত, ধীরে ধীরে সামস্তপ্রভুদের মধ্যে শুরু হয় স্বার্থের তারা শোষণের রাজত্ব বজায় রাখতে একে অপরের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পরস্পরের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
এভাবে বিভিন্ন কারণে সামস্তপ্রথার অবসান ঘটে। সামস্তপ্রথার পতনের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন অর্থনীতির বিকাশ ঘটে যা আধুনিক যুগের ঊষালগ্ন সূচিত করেছিল।